About us

প্রথমেই হাওড়া সেবা সঙ্ঘের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। শতবর্ষে পদার্পণকারী হাওড়া সেবা সঙ্ঘ হাওড়াবাসীর কাছে এক অতি পরিচিত নাম। ১৯২৩ সালে পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতাকামী একদল দেশব্রতী মানুষ পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য এমন এক প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছিলেন যেখানে গড়ে উঠবে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের দল। শিক্ষাদান, সংগঠন এবং একতা – এই ত্রয়ী আদর্শকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘হাওড়া সেবা সঙ্ঘ’। লাঠিখেলা, ছোড়াখেলা, যোগব্যায়াম, জিমন্যাস্টিক ইত্যাদি শিক্ষার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত দেশভক্ত গড়ার কাজ পূর্বসূরীরা আরম্ভ করেছিলেন। সেকালের বিশিষ্ট বিপ্লবী স্বর্গীয় হরেন্রনাথ ঘোষ এবং তাঁর ছোটভাই স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয় ছিলেন এই প্রতিষ্ঠান গঠনের নেপথ্যে। শুধু দেশোদ্ধারের কারিগর তৈরী করাই নয়, তাদের দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাঁরা শক্তি আরাধনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯২৭ সালে আরম্ভ করলেন শারদীয়া দুর্গাপূজা যা মধ্য হাওড়ার প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো। হাওড়া জেলার তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল গেজেটে সরকারিভাবে এই পুজোকে হাওড়ার প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন তাঁরা বীরাষ্টমী ব্রত পালন করা শুরু করেছিলেন যেখানে সঙ্ঘের সদস্যরা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা সহ নানাধরণের শারীরিক কলাকৌশল প্রদর্শন করতেন। আজও সেই ধারা বজায় আছে। এখন লাঠিখেলা, ছোরাখেলা না হলেও যোগব্যায়াম, জিমন্যাস্টিক সহ নানা শারীরিক কলাকৌশল প্রদর্শন করা হয়। প্রথমবার দুর্গাপুজোয় একটি স্বদেশী মেলার আয়োজন করা হয়েছিল যার উদ্বোধন করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের সহধর্মিণী বিপ্লবী নেলী সেনগুপ্ত। এছাড়া সঙ্ঘ সদস্যরা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর সমিতির সঙ্গেও সঙ্ঘের যোগাযোগ ছিল। চরমপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার সঙ্ঘকে বেআইনী ঘোষণা করে এবং সঙ্ঘের যাবতীয় কাগজপত্র বাজেয়াপ্তও করা হয়েছিল৷ নেতাজীর মহানিষ্ক্রমণের আগের শেষ জনসভা তিনি করেছিলেন হাওড়া সেবা সঙ্মের মাঠে যেখানে বর্তমানে তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন অবস্থিত। সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতারা সামরিক বাদ্যবিভাগও তৈরি করেছিলেন যা আজও সুনামের সঙ্গে চলছে। রামগড়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও ডাঃ শিশির কুমার বসুর এই সামরিক বাদ্যবিভাগ আমন্ত্রিত হয়ে মিলিটারি ব্যান্ড বাজিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করেছিলেন৷ ব্রিটিশ যুগের চরমপন্থী বিপ্লবী সুশীল ব্যানাজী ছিলেন এই সঙ্ঘের সদস্য যিনি পরিচিত মহলে সোনাদা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মহাষন্ঠীর দিন দুর্গাপুজোর মন্ডপ থেকে রিভলভার সমেত ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং বিচারে আন্দামানে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল৷ স্বাধীনতার পর তিনি সেখান থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে পুনরায় সঙ্ঘে যোগ দিয়েছিলেন।

এই সুদীর্ঘ চলার পথে হাওড়া সেবা সঙ্ঘ বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছে। শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঁকারনাথ, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক হরিপদ ভারতী, সাহিত্যিক অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো), বিশিষ্ট গায়ক সবিতাব্রত দত্ত প্রমুখ বিভিন্ন গুণীজন নানাসময়ে সঙ্গে পদার্পণ করেছেন।


সেকাল থেকে একালের দুর্গাপূজা, হাওড়া সেবা সংঘ – The past and present history of our Durga Puja

নগর হাওড়ার সবথেকে প্রাচীন বারোয়ারী (সর্বজনীন) পুজো হয় হাওড়া সেবা সংঘে। শুরু হয় ১৯২৭ সালে। সংঘ প্রতিষ্ঠা হয় আরও বছর চারেক আগে ১৯২৩ সালে। স্বাধীনতার আগে স্থানীয় যুবকদের স্বাধীনতার আন্দোলনে আগ্রহী করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে সংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল। সংঘের প্রতিষ্ঠা সদস্যদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অনুগামী স্বর্গতঃ হরেন্দ্রনাথ ঘোষের দাদা স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের প্রাথমিক উদ্যোগে হাওড়া শহরে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয়। এর উল্লেখ রয়েছে West Bengal District Gazette,1972” (Chapter-XV Pg No. 536) “ The first Sarbojanin Durgotsav (Community Worship of Goddess Durga) in Howrah District was Sponsored by it in 1927″। সংঘের কর্মীরা দুর্গাপূজা করার পর স্থানীয় মানুষজন সংঘ সম্বন্ধে আগ্রহী হন। সদস্যদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জানতে পারেন। অনেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তখন এই অঞ্চল ব্যাঁটরা গ্রাম নামে পরিচিত। পুরানো তথ্য অনুযায়ী কলকাতার সিমলা ব্যায়াম সমিতির কর্মকর্তা অতীন বসুর প্রেরণায় শুরু হয় দুর্গোৎসব। প্রথমবার অতীনবাবুই প্রতিমা কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিমার দাম ছিল ১৫টাকা। সেবার মোট চাদা উঠেছিল ১০০টাকা।

প্রথম পূজা শুরু হয় জয়দেব কুন্ডু বাই লেনে। বর্তমানে অভয়পদ কুণ্ডু লেন ও বৃন্দাবন মল্লিক লেনের মুখোমুখি (এখন সেই নামের অস্তিত্ব নেই) রঘুনাথ দাসের জমিতে । তারপর শুরু হল বামাচরণ কুণ্ডুর (বর্তমানে সেখানে তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন অবস্থিত) ফুলবাগানে। এই স্থানেই সিমলা ব্যায়াম সমিতির মত দুর্গা পূজার সাথে রাজনৈতিক নানা ধরনের পুতুল তৈরী করে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ক্ষুদিরামের ফাঁসি, রাইটার্স বিল্ডিং-এ বিনয়-বাদল-দীনেশের অলিন্দ যুদ্ধ,চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, সমস্তই সাজানো হয়েছিল পুতুল দিয়ে। প্রদর্শনটি স্থায়ী হয়েছিল ৩৬দিন। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের সহধর্মিনী শ্রীমতী নেলী সেনগুপ্তা।

দুর্গাপূজার শুরুর তৃতীয় বৎসর থেকে মহাষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী ব্রত পালন উৎসব শুরু হয়। তা আজও বজায় আছে। বীরাষ্টমী ব্রত পালন অনুষ্ঠানে প্রথম দিকে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা দিয়ে শুরু করে পরবতী পর্যায়ে এই দিনে ব্রতচারী, জিমন্যাস্টিক, যোগব্যায়াম ও দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মহাসপ্তমীর সন্ধ্যায় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, নবমীর সন্ধ্যায় মায়ের নাম গান ও লক্ষ্মীপুজোর দিন শিশু স্বাস্থ্য প্রতিযোগিতা সকলের সহযোগিতায় এখনও বজায় আছে।

দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মানুষের চেতনা বৃদ্ধির কাজেই সংঘের কর্তারা মনোনিবেশ করেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, সংঘ বেশীদিন রাজরোষ এড়িয়ে চলতে পারেনি। পুলিশ বেশ কয়েকবার সংঘ ভবন তল্লাশি করে,বহু নথিপত্র নষ্ট করে দেয়।

বিপ্লবী কার্যকলাপ, আইন অমান্য আন্দোলন যোগ দিয়ে সংঘের বহু সদস্য কারাবরণ করেন। এইসময় সংঘ বেআইনী ঘোষিত হয়।

১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল সংঘের পুজো বন্ধ ছিল। সে ছিল বড় দুর্যোগের সময়। ’৪২ সালে ভারতছাড়ো আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় সংঘের সদস্যরা। ’৪৩-এ এল দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ নরনারী ভিড় করল শহরে। সেই বৎসরও পরিচালকমন্ডলী পুজো বন্ধ রাখলেন। এর জেরে আরও এক বৎসর পুজো বন্ধ রইল। ফের শুরু হল তারপরে।

সেই আমলে ঠাকুর তৈরী করার পদ্ধতি ছিল অন্য। মৌলালি থেকে রিকশায় করে নিয়ে আসা হত গরান গাছের গুঁড়ি। বালটিকুরী থেকে আনা হত ধানের তুষ। প্রতিমা তৈরীর মাটিতে তুষ মেশানো হত যাতে মনোমতো চিটে তৈরী হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সংঘের প্রতিমা তৈরী করেছেন কুমোরটুলির প্রভাস পাল ও তার পর তাঁর পুত্র গৌর পাল। এরপর হাওড়ার মুরারী রায় ও তাঁর ছেলের হাত ঘুরে বাসুদেব পাল দু-বছর করেন। এর মধ্যে কুমোরটুলির হেমন্ত পাল একক ভাবে কিছু বছর ঠাকুর তৈরী করেন। বর্তমানে বেশ কিছু বছর ধরে ঠাকুর গড়ার দায়িত্বে আছেন হাওড়ার আর এক পটুয়া দিলীপ রাম।

প্রতিমাকে শোলা দিয়ে সুন্দর রূপ দিয়ে বর্ধমান থেকে দীর্ঘ সময় ঠাকুর সাজিয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী রবীন মালাকার ও তার পিতা। এরপর ঝন্টু মালাকারও দীর্ঘদিন দিন এবং হাওড়ার প্রণব দাঁ এই কাজে যুক্ত ছিলেন। কাটোয়ার শিল্পী অমৃতলাল ঘোষও পরপর দুই বৎসর প্রতিমার শোলার কাজ করেছেন।

প্রতিমার নিরঞ্জন নিয়ে অনেক গল্প আছে। প্রতিমার উচ্চতা প্রথমদিকে ছিল ১৯ ফুট। স্বাধীনতার আগে ট্রাম, টেলিফোন এবং ইলেকট্রিক তারের জন্য প্রতিমা নিয়ে যেতে অসুবিধা হয়েছে। আবেদন করে ইলেকট্রিক কোম্পানীকে রাজী করানো গেল। তারা বলল তার গুটিয়ে নেবে। টেলিফোনের কর্তারাও একই কথা বলল। ট্রাম কর্তারা বললেন, ১২০০ টাকা দিতে হবে। পুলিশেরও অনুমতি নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তারও সমাধান হল। এরপরও দীর্ঘদিন ইলেকট্রিক তারের সমস্যা মেটানো হয়েছে, সি.ই.এস.সির সহযোগিতায়। প্রাতিমা সজ্জার শেষে শোভাযাত্রার সূচনায় ল্যাম্পপোস্টের ফিউজ নিভিয়ে দেওয়া হত। নরসিংহ দত্ত রোড পেরিয়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র রোড-এ প্রতিমার পৌছান মাত্র শুরু হত বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার। ২০০২ সাল থেকে ফোল্ডিং চালচিত্র নির্মাণ করার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যার সুরাহা হয়েছে।

একসময় নিরঞ্জনে আলাদা আলাদা ভাবে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হত। এমনকি নিরঞ্জনের পর পুরো কাঠামোটি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হত। সংঘ সদস্যের প্রচেষ্টায় ট্রলিতে ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেবলমাত্র নীচের কাঠামোটি আবার ফিরিয়ে আনা হয় আগামী বৎসরের প্রতীক্ষায়।